ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড, এক বিস্ময়কর খাদ্য উপাদান!
“ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড” বর্তমান সময়ের সবচেয়ে আলোচিত শব্দ! আজ পর্যন্ত এমন কোন ফ্যাটি এসিড নিয়ে এত বেশি আলোচনা হয়নি, যতটা হয়েছে এবং চলছে এই ওমেগা-৩ কে নিয়ে! কি হতে পারে তার কারণ? কেনইবা এত বেশি আলোচনা ?
গবেষণায় দেখা গেছে, জাপানিদের গড় আয়ু বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে বেশী। যদিও এদের খাদ্য তালিকা ভিন্ন, কিন্তু একটা জিনিস খুব কমন – এদের সবারই খাদ্য তালিকায় রয়েছে সমৃদ্ধ মাত্রায় ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড!
ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড কি?
‘ওমেগা-৩’ হল এক ধরনের অসম্পৃক্ত চর্বি। স্বাস্থ্যসচেতন মানুষ মাত্রই জানেন, সম্পৃক্ত চর্বি হৃদযন্ত্রের জন্য ক্ষতিকর। তেল-চর্বিযুক্ত খাবার একটা বয়সের পর সে কারণে খেতে মানা।
কিন্তু অসম্পৃক্ত চর্বিযুক্ত খাবার খেতে বাঁধা নেই, বরং এটি রক্তে উপকারী চর্বির পরিমাণ বাড়ায় এবং দেহের নানা উপকার করে।
প্রকৃতিতে কয়েক ধরনের ‘ওমেগা-৩’ চর্বি আছে। এর মধ্যে ‘আলফা লিনোলেইক’ এসিড পাওয়া যায় কিছু উদ্ভিজ্জ্ব খাবার বা তেলে। অন্যদিকে সামুদ্রিক খাবারে পাওয়া যায় ‘ইকোসা পেন্টানোয়িক অ্যাসিড’ এবং ‘ডোকোসা হেক্সানোয়িক অ্যাসিড’।
চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের মতে আমাদের খাদ্যে প্রধান উপাদান তিনটি। কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন ও চর্বি। এর মধ্যে চর্বির প্রধান কাজ হল দেহে শক্তি যোগানো। চর্বি থেকে সমপরিমাণ কার্বোহাইড্রেট বা প্রোটিনের চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি শক্তি মেলে।
শরীরের চর্বি আবার তিন ধরনের- ট্রাইগ্লিসারাইড, কোলেস্টেরল আর ফসফোলিপিড। এদের মধ্যে আবার ট্রাইগ্লিসারাইডের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি। ট্রাই গ্লিসারাইড তৈরি হয় তিনটি ফ্যাটি এসিডের সঙ্গে গ্লাইসেরল মিলে।
স্যাচুরেটেড বা সম্পৃক্ত ফ্যাটি এসিড দিয়ে তৈরি চর্বি শরীরে কোলেস্টেরলের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়ে ধমনীর ভেতরের গায়ে লেগে যায়। এতে ধমনীর ব্যাস ক্রমশ ছোট হয়ে আসে। ফলে রক্তচাপ বেড়ে যায়।
দুধ, ঘি, মাখন, মাংস, ক্রিম, ডিম, চকোলেট ইত্যাদি সম্পৃক্ত ফ্যাটি এসিডের উৎস। এই সম্পৃক্ত ফ্যাটি এসিডগুলো স্বাভাবিক তাপমাত্রায় কঠিন আর অসম্পৃক্ত ফ্যাটি এসিডগুলো তরল হয়।
মোনোআনস্যাচুরেটেড চর্বি পাওয়া যায় সমস্ত ধরনের বাদাম, জলপাই তেল, এবং ক্যানোলা তেল এ। মোনোআনস্যাচুরেটেড ফ্যাট রক্তের খারাপ কোলেস্টেরল এলডিএল কমায়। তাই এর ব্যবহার নিঃসন্দেহে রক্তে খারাপ কোলেস্টেরল বা এলডিএল এর মাত্রা কমিয়ে কোলেস্টেরল জনিত ধমনীর রোগ প্রতিহত করে। পলি আনস্যাচুরেটেড চর্বি পাওয়া যায় সয়াবিন, সূর্যমুখীর তেল, ভুট্টা ইত্যাদিতে।
ওমেগা-৩ এর কাজ
- প্রদাহ কমানো
- অপ্রয়োজনীয় রক্ত জমাট বাঁধা প্রতিহত করা
- ইনসুলিনের কার্যকারিতা বাড়ানো
- রক্তের কোলেস্টেরল কমানো
- প্লাটিলেট বা অনুচক্রিকা জড়ো হওয়া কমানো
- রক্তে ট্রাই গ্লিসারাইড কমানো
- ক্যানসার কোষের বাড়া প্রতিহত করা
- পুরু হয়ে যাওয়া রক্তনালীর প্রসারণে সহায়তা
- শরীরের রোগ প্রতিরোধ বাড়ানো ইত্যাদি।
ওমেগা-৩ এর উপকারিতা
- হৃদরোগ প্রতিরোধ করা
- হৃৎপিন্ডকে সবল রাখা
- শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানো
- শরীরের রক্তচাপ কমানো
- রক্তের ট্রাইগ্লিসারাইড নিয়ন্ত্রণে রাখা এবং কোলেস্টেরল কমিয়ে স্ট্রোক প্রতিরোধ করা
- ক্যানসার, রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস প্রতিরোধ করা
- মানসিক রোগ যেমন- ডিপ্রেশন, ডিমেনশিয়া, অ্যাটেনশন ডেফিসিট, হাইপার অ্যাকটিভি ডিজর্ডার প্রতিরোধ করা
- শিশুদের সুস্থ সবলভাবে বেড়ে ওঠার জন্য যথেস্ট পরিমাণ ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড প্রয়োজন, ইত্যাদি।
ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড যুক্ত খাবার তালিকা
ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড পাওয়া যায় এমন খাবারের মধ্যে আছে বিভিন্ন সামুদ্রিক মাছ(স্যামন, হ্যালিবাট, টুনা, সারডিন্যাস, ম্যাকেরেল, হেরিং), ওমেগা-৩ সমৃদ্ধ ডিম ও বিভিন্ন প্রকার শাক সবজি – যেমন পালং শাক, ব্রকলি ইত্যাদিতে যথেষ্ট পরিমাণে ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড থাকে।
ইলিশ, রুপচাঁদা ও পাঙ্গাশ মাছে অল্প পরিমাণ ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড পাওয়ার প্রমাণ মেলে।
বিভিন্ন ধরনের বাদামে আছে ওমেগা-৩। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি পরিমাণে আছে ওয়ালনাট বা আখরোট, পেস্তা ইত্যাদি বাদামে।
ওমেগা-৬ সমৃদ্ধ খাবারের মধ্যে আছে তিল, তিশি, বাদাম, মিষ্টিকুমরা, দুগ্ধজাত পণ্য, শস্য জাতীয় খাদ্য, সূর্য্যমুখীর তেল প্রভৃতি।
আমাদের খাদ্য তালিকায় যে পরিমাণ এবং যে প্রজাতির মাছ থাকে তা থেকে পর্যাপ্ত পরিমাণ ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড পাবার আশা করা যায় না ।
ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড যুক্ত মাছ
প্রায় সব মাছেই কম বেশি ওমেগা–৩ চর্বি থাকে। তবে সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায় সামুদ্রিক মাছে।
সামুদ্রিক মাছের তেল ওমেগা-৩ এর উৎকৃষ্ট উৎস। ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড পাওয়া যায় এমন বিভিন্ন সামুদ্রিক মাছ যেমন – স্যামন, হ্যালিবাট, টুনা, সারডিন্যাস, ম্যাকেরেল, হেরিং ইত্যাদি।
ইলিশ, রুপচাঁদা, পাঙ্গাশ, রুই, মাগুর মাছে অল্প পরিমাণ ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড পাওয়ার প্রমাণ মেলে।
ওমেগা-৩ ক্যাপসুল খাওয়ার উপকারিতা
মাছের আঁশটে গন্ধ, অ্যালার্জি, বা অন্য কোন সমস্যার কারণে যদি আপনি মাছ খেতে না পারেন তাহলে ওমেগা-৩ ক্যাপসুল খেতে পারেন। শরীরে পলিআনস্যাচুরেটেড ফ্যাটের ঘাটতি পূরণ করতেও সাপ্লিমেন্ট হিসেবে ওমেগা-৩ সেবন করতে পারেন।
ওমেগা-৩ হচ্ছে পলিআনস্যাচুরেটেড ফ্যাট যা রক্তে সহজে মিশে যায়। এতে বিদ্যমান প্রয়োজনীয় অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট মেটাবলিজম বাড়ায়, হার্ট সুস্থ রাখে, রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়, রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখে, এবং হাড় ও মাংসপেশি সুগঠিত করে।
ওমেগা-৩ ক্যাপসুল খাওয়ার অপকারিতা
ফিশ অয়েলের যেমন এত উপকারিতা (Benefits) রয়েছে, ঠিক সেরকমই কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও রয়েছে। অনেকেরই নানারকম মাছে অ্যালারজি থাকে, বিশেষ করে ইলিশ, চিংড়ি বা সামুদ্রিক মাছে। তাঁরা যদি ফিশ অয়েল ক্যাপসুল খেতে চান, সেক্ষেত্রে সবার আগে ডাক্তারের সঙ্গে আলোচনা করে নেওয়াটা শ্রেয়। এছাড়াও অনেকসময়ে প্রথমদিকে একটু বমিভাব বা ঘামে দুর্গন্ধ হতে পারে ফিশ অয়েল খাওয়া শুরু করলে।
ওমেগা-৩ ক্যাপসুল খাওয়ার নিয়ম, সেবনমাত্রা
ওমেগা-৩ ক্যাপসুল আপনি দিনের যেকোন সময় খেতে পারবেন, অবশ্যই খাবার গ্রহণের পরে।
প্রতিদিন কয়বার ক্যাপসুল খেতে পারবেন সেটা ডাক্তার আপনার শারীরিক অবস্থা, বয়স, এবং রোগের মাত্রা দেখে নির্ধারণ করে দিবেন।
সাধারণত প্রতিদিন ২৫০ মিলিগ্রাম থেকে ১০০০ মিলিগ্রাম পর্যন্ত ওমেগা-৩ ক্যাপসুল সেবন করা যায়। তবে দৈনিক সেবনের মাত্রা ৪০০০ মিলিগ্রামের বেশি করা একদমই উচিত নয়, নাহলে ইন্টার্নাল ব্লিডিং সহ আরো নানা ধরণের জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে। ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী গ্রহণ করাটাই শ্রেয়।
উপসংহার
ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড মানব শরিরের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় একটি খাদ্যপ্রাণ, যার অভাবে আমরা অনেক ধরনের শারীরিক ও মানসিক জটিল সমস্যায় ভুগতে পারি।
তাই প্রতিদিনের জন্য প্রয়োজনীয় ওমেগা-৩ গ্রহণ করা যেমন অত্যাবশ্যক তেমনি আবার অতিরিক্ত পরিমাণ গ্রহণও বিপদজনক!
প্রয়োজন মেটাতে ওমেগা-৩ ক্যাপসুল ও গ্রহণ করা যেতে পারে, তবে তা অবশ্যই ভাল মানের ও ব্রান্ডের হওয়াটা অত্যাবশ্যক। ওমেগা-৩ ক্যাপসুল ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী গ্রহণ করাটাই শ্রেয়।
প্রতিদিনের সুষম (Balanced Diet) খাবার গ্রহণের মাধ্যমে ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড এর প্রয়োজনীয় মাত্রা পূরণ করাটাই শ্রেও। ধন্যবাদ সবাইকে।
কোলেস্টেরলঃ গল্পচ্ছলে শরীর নিয়ে লেখা,নিছক কৌতুক নয় !
সুপারফুড চিয়া সিড পৃথিবীর সবচেয়ে পুষ্টিগুণ সম্পন্ন খাদ্য বীজ!
হাঁটার উপকারিতা সত্যিই অকল্পনিও! সর্বোৎকৃষ্ট ব্যায়াম ও বটে!