সুপারফুড চিয়া সিড পৃথিবীর সবচেয়ে পুষ্টিগুণ সম্পন্ন খাদ্য বীজ!
চিয়া সিড বা বীজ কি ? What is Chia Seed ?
চিয়া সিড বা চিয়া বীজ মরুভূমিতে জন্মানো সালভিয়া হিসপানিকা (Salvia Hispanica) উদ্ভিদের বীজ। এই অতি উপকারি বীজটির আদি জন্মস্থান সেন্ট্রাল আমেরিকা এবং সেখানকার প্রাচীন আদিবাসি অ্যাজটেক জাতির খাদ্য তালিকায় এই বীজ অন্তর্ভুক্ত থাকার প্রমাণ পাওয়া যায়।
প্রাচীন মায়া এবং অ্যাজটেক জাতির মানুষ চিয়া সিডকে স্বর্ণের চেয়েও মূল্যবাণ মনে করত। তারা বিশ্বাস করত এটা তাদের শক্তি ও সাহস এর প্রতিক! তারা এই বীজকে দীর্ঘস্থায়ী শারীরিক শক্তিদানের ক্ষমতার জন্য খুব মূল্য দিত। আসলে, প্রাচীন মায়া ভাষায় ‘চিয়া’ মানে ‘শক্তি’।
চিয়া সিড সব ধরণের আবহাওয়ায় হয় এবং এতে পোকামাকড়ের আক্রমণ তেমন হয় না। চিয়া বীজ সাদা ও কালো রং এর এবং তিলের মত ছোট সাইজের হয়।
চিয়া একটি সুপার সিড যাতে আছে প্রচুর পরিমানে ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড; কোয়েরসেটিন(Quercetin) কেম্পফেরল(Kaempferol) ক্লোরোজেনিক এসিড(Chlorogenic acid) এবং ক্যাফিক এসিড(Caffeic acid) নামক এন্টিঅক্সিডেন্ট; পটাশিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম এবং দ্রবণীয় ও অদ্রবণীয় আঁশ(ফাইবার)।
চিয়া সিড এর পুষ্টিগুণঃ
চিয়া বীজ একটি সুপার ফুড। এর মধ্যে রয়েছে অবাক করা পুষ্টিগুণ!
- দুধের চেয়ে ৫ গুণ বেশী ক্যালসিয়াম
- কমলার চেয়ে ৭ গুণ বেশি ভিটামিন সি
- পালং শাকের চেয়ে ৩ গুণ বেশী আয়রন (লোহা)
- কলার চেয়ে দ্বিগুণ পটাশিয়াম
- স্যামন মাছের থেকে ৮ গুণ বেশী ওমেগা-৩
এতে রয়েছে ওমেগা-৩ জাতীয় ফ্যাটি অ্যাসিড যে কারণে এটি হার্টের পক্ষে খুব ভালো। এটি আমাদের রক্তে HDL cholesterol বাড়ায় যা শরীরের জন্য ভালো। এছাড়াও প্রচুর পরিমাণে রয়েছে প্রোটিন ও ফাইবার। রয়েছে আয়রন এবং ক্যালসিয়ামও।
এক আউন্স বা ৩০ গ্রাম (প্রায়) চিয়া বীজে রয়েছে প্রায় ৬ গ্রাম প্রোটিন, ৮.৫ গ্রাম ফ্যাট, ১১ গ্রাম ফাইবার, ১৩ গ্রাম কার্বোহাইড্রেট (যার মধ্যে ১১ গ্রাম হল ফাইবার)।
দৈনিক এক আউন্স চিয়া বীজ খেলে ১৮% কালসিয়ামের চাহিদা, ২৭% ফসফরাসের চাহিদা এবং ৩০% ম্যাঙ্গানিজের চাহিদা পূরণ হতে পারে। বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই আমরা এই গুরুত্বপূর্ণ পুষ্টি উপাদান গুলি পর্যাপ্ত পরিমাণে খাই না, সেক্ষেত্রে এই চিয়া বীজ খুবই উপকারী।
চিয়া সিড এর (Chia seed) উপকারিতাঃ
১) চিয়া সিড এ রয়েছে উচ্চমাএার এন্টিঅক্সিডেন্ট
এন্টিঅক্সিডেন্ট ত্বক ও দেহের অভ্যন্তরীণ কোষ রক্ষণাবেক্ষণে বেশ উপকারি ৷ চিয়া সিডএ থাকা এন্টিঅক্সিডেন্ট আমাদের ত্বকের স্পর্শকাতর ফ্যাট রক্ষা করে। তাছাড়া ত্বকে বলিরেখা পড়া রোধ এবং কোষ গুলোকে ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করে।
২) চিয়া সিড এ রয়েছে উচ্চমাত্রার প্রোটিন
প্রোটিন আমাদের দেহের জন্য অত্যন্ত উপকারি। তবে বর্তমানে অধিক প্রোটিন গ্রহণ দেহের ক্ষতির কারণ হয়ে দাড়ায়। চিয়া সিড সেক্ষেত্রে আপনার জন্য বেশ উপযোগী একটি খাবার ৷ প্রতিদিন ১ আউন্স অর্থাৎ ২৮ গ্রাম চিয়া সীড থেকে ৪ গ্রাম প্রোটিন পাওয়া যায়। যাদের প্রোটিন গ্রহণে সমস্যা রয়েছে বা যারা নিরামিষ ভোজী, তারা খুব সহজে চিয়া সিড নিয়মিত গ্রহনের মাধ্যমে প্রোটিন পেয়ে যাবেন।
৩) উচ্চমাত্রার ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড রয়েছে চিয়া সিড এ
তিসির বীজের মতো চিয়া সিড ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড সমৃদ্ধ। এক গবেষণায় দেখা গেছে স্যালমন মাছের চেয়ে বেশি ওমেগা -৩ ফ্যাটি এসিড পাওয়া যায় চিয়া সিডএ। ওমেগা -৩ ফ্যাটি এসিডের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো ALA( alpha linolenic acid) যা হার্ট সুস্থ রাখতে সাহায্য করে।
৪) হাড়ের সুস্থতায় চিয়া সিড
হাড়কে সুস্থ ও মজবুত রাখতে,আমরা জানি প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবারের বিকল্প নেই। কিন্তু বর্তমান সময়ের গবেষণার এক রিপোর্টে উঠে এসেছে যে, চিয়া সিডএ রয়েছে ক্যালসিয়াম, ফরসফরাস এবং প্রোটিন। চিয়া সিডএ ক্যালসিয়ামে রয়েছে ১৮%, যা আপনার হাড়কে সুস্থ রাখতে যথেষ্ট। মজার বিষয় হচ্ছে, যে কোন ডেইরি প্রোডাক্টের চেয়ে ক্যালসিয়াম বেশি পাওয়া যায়। নিরামিষ ভোজী থেকে আমিষ ভোজী সকলের জন্য চমৎকার ক্যালসিয়ামের উৎস চিয়া সিড।
৫) রক্তের সুগার লেভেল কমাতে সাহায্য করে
রক্তের সুগার লেভেল বৃদ্ধি পাওয়া টাইপ-২ ডায়বেটিসের প্রধান লক্ষণ। ক্রমাগত ভাবে রক্তের সুগার লেভেল এভাবে বৃদ্ধি পাওয়া হার্টের সমস্যা বৃদ্ধির অন্যতম কারণ।
আশার কথা হচ্ছে, চিয়া সিড নিয়মিত গ্রহনে রক্তে ইনসুলিনের সেনসিটিভিটি মাএা কমাতে সাহায্য করে। নিয়মিত চিয়া সিড আপনাকে অনেকটা রক্তের সুগার লেভেল বৃদ্ধি হওয়া কমাতে সাহায্য করবে এবং হার্টকে রাখবে সুস্থ।
৬) ত্বকের সংক্রমনের মাএা কমায়
প্রতিদিনের দূষণ, অস্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণ এবং কৃএিম প্রসাধনীর দাপটে ত্বকের সংক্রমণ নিত্য বিষয় হয়ে দাড়িয়েছে আমাদের জীবনে। চিয়া সিড আপনাকে এই ত্বকের সংক্রমণের হাত থেকে রক্ষা করবে।
প্রতিদিন ৩৭ গ্রাম নিয়মিত গ্রহণে ত্বকের এই সমস্যা থেকে মুক্তি মিলবে। মূলত এর নিয়মিত গ্রহণ রক্তের কনিকা সমূহ সুস্থ থাকে এবং ত্বকে অক্সিজেনের মাএা বৃদ্ধি করে। ফলে আপনার ত্বক ভিতর ও বাহির থেকে হয়ে ওঠে স্বাস্থ্যউজ্জ্বল।
৭) ওজন কমাতে সাহায্য করে
Chia seed আপনার ডায়েট চার্টের জন্য যথা উপযুক্ত খাবার৷ কারন, চিয়া সিড আপনি যে খাবারের সাথে মিশিয়ে গ্রহণ করুন না কেন, পেটে যাবার পর তা ফুলতে শুরু করে এবং আপনার পেট ভরে যায়। ফলে ক্ষুধা কমে যায় এবং অতিরিক্ত খাদ্য গ্রহণ করার প্রবনতা হ্রাস পায় ।
সেক্ষেত্রে আপনার বাড়তি ওজন সহজে ঝরে গিয়ে চলে আসবে স্বাভাবিক আকারে। এখানে একটু বলে রাখা ভালো,চিয়া সিড খাবার হজমে বেশ সহায়তাকারি।
চিয়া সিড মানবদেহের জন্য খুবই উপকারি সব দিক থেকে। আপনার দেহের অভ্যন্তরীণ রক্ষণাবেক্ষণ সহ বাহ্যিক সৌন্দর্যের জন্য চিয়া সীড সিড কাজ করে থাকে। তাই বলা যায়, শুধু শরীর সুস্থ রাখতে এবং সৌন্দর্য বজায় রাখতে চিয়া সিডএর ভূমিকা অসামান্য।
চিয়া সিড খাওয়ার নিয়মঃ
স্থান ভেদে চিয়া বীজ খাবার নিয়ম বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন রকম হয়ে থাকে। বিভিন্ন ফলের রস এর সাথে বা পানিতে মিশিয়ে সাধারণত চিয়া সিড খাওয়া হয়ে থাকে।
স্বাদ ও ঘ্রাণহীন হয়ে থাকে বলে অনেক দেশে রুটি বা বিস্কুট এর সাথেও এটি সেবন করা হয়ে থাকে।
তবে ১ গ্লাস পানি-তে ১ চা চামচ পরিমান নিয়ে ভালো ভাবে মিশিয়ে আধা ঘন্টা ভিজিয়ে রেখে খালি পেটে খেলে ভালো উপকার মেলে।
চিয়া বীজ কোথায় পাওয়া যায় ?
বাংলাদেশেও এই চিয়া বীজ পাওয়া যায়। সহজপ্রাপ্য না হলেও দেশের বিভিন্ন বড় বড় দোকান ও সুপারশপে এই চিয়া সিড পাওয়া যায়। ভালমানের চিয়া বীজ প্রতি ১০০গ্রাম ২০০/৩০০ টাকা দামে বাংলাদেশের বিভিন্ন বড় বড় দোকানে পাওয়া যায়।
মূলত ব্যাপক পরিসরে বাংলাদেশে এর চাষাবাদ শুরু না হওয়ায় এটি সব জায়গায় সমান ভাবে পাওয়া যায়না এবং পাওয়া গেলেও দামের তারতম্য থেকে যায়।
বাংলাদেশের বিভিন্ন অনলাইন শপেও এই বীজ পাওয়া যায়। অতীব উপকারী ও পুষ্টিকর এই চিয়া সিড বা বীজ আপনারা অনলাইন থেকেও সহজেই কিনতে পারেন।
চিয়া সিড এর (Chia seed) অপকারিতাঃ
চিয়া বীজের অনেকগুলি স্বাস্থ্য উপকারিতা রয়েছে। তবে এর অনেক সুবিধা থাকলেও অসুবিধাও রয়েছে এবং সেটার সম্পর্কে জানা খুব গুরুত্বপূর্ণ।
কিছু বিজ্ঞানী দ্বারা পরিচালিত পরীক্ষায় দেখা গেছে যে এর বীজগুলি প্রোটেস্ট ক্যান্সার এবং স্তন ক্যান্সারকে বাড়িয়ে তুলতে পারে। সুতরাং এটি সীমিত পরিমাণে ব্যবহার করা উচিত।
চিয়া বীজ বেশি খাওয়ার ফলে পেটের সমস্যা হতে পারে। কারণ চিয়া বীজের মধ্যে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার থাকে। তাই অল্প পরিমাণে চিয়া সেবন করুন।
যদি চিয়া বীজ গ্রহণ করে কোন ধরণের স্বাস্থ্য সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে তাহলে সঙ্গে সঙ্গে এটি সেবন করা বন্ধ করুন।
এলার্জি জনিত সমস্যা হতে পারে। অতিরিক্ত পরিমাণ চিয়া বীজ খাওয়ায় রক্তচাপ বেশি কমে যেতে পারে।
উপসংহারঃ
চিয়া সিড একটি সুপারফুড হিসাবে সারা পৃথিবীতে খ্যাত । প্রচুর পুষ্টিগুণ সম্পন্ন এই বীজ মানুষের দেহের জন্য খুবই উপকারী । তবে এত পুষ্টিগুণ সম্পন্ন এই খাবারও অন্য যেকোনো খাবার বা উপাদানের মতই বেশি পরিমাণে খাওয়া ক্ষতিকর। তাই চিয়া বীজের অনেক উপকারীতা থাকা সত্ত্বেও এটি পরিমান মত গ্রহণের মধ্যেই সর্বাঙ্গীণ মঙ্গল নিহীত। ধন্যবাদ সবাইকে!