Success

“এ এস দিলীপ কুমার” থেকে “এ আর রহমান” – অভাবে আশ্রয় দিয়েছিল সুফিবাদ!

ন’বছরের ছেলে এ এস দিলীপ কুমারকে তাঁর স্কুলের শিক্ষিকা বাড়ি চলে যেতে বললেন। কিছু না বুঝেই স্কুল থেকে বাড়ি ফিরল সে। তার পর যা করতে হল, তারও অর্থ সে সময় অধরা ছিল তার কাছে। শুনল, তার বাবা মারা গিয়েছেন। তাকে এ বার মুখাগ্নি করতে হবে!

কিছু না বুঝেই সব নিয়ম পালন করেছিল সে। এর পর শুরু হল অভাবের সঙ্গে দিলীপের যুদ্ধ। ঘরে ছোট ছোট ভাইবোন, আর অসহায় মা কস্তুরী। সঞ্চয়ের প্রায় সবই শেষ হয়ে গিয়েছিল অসুস্থ বাবার চিকিৎসায়।

দিলীপের বাবা আর কে শেখর মালয়লম ছবির ইন্ডাস্ট্রিতে সুরকার ছিলেন। বেশ কিছু ছবিতে কাজ করেছিলেন মিউজিক কন্ডাক্টর হিসেবেও। তাঁর সঙ্গে কিছু সময় কি বোর্ড বাজাত ছোট্ট দিলীপ। মাত্র ৪৩ বছর বয়সে প্রয়াত হন আর কে শেখর।

এর পর আরও দু’টি স্কুলে ভর্তি হয় সে। কিন্তু এক দিকে সংসার, অন্য দিকে পড়াশোনা, দুই নৌকায় পা রেখে চলা সম্ভব হল না। মায়ের সঙ্গে কথা বলে পড়াশোনায় ইতি টানল কিশোর দিলীপ। স্কুল ছেড়ে নিজেকে উৎসর্গ করল সঙ্গীতের পায়ে।

AR Rahman 2

দিলীপের আগ্রহ ছিল বাদ্যযন্ত্রে। এগারো বছর বয়স থেকে শুরু করে তিনি দীর্ঘদিন তালিম নেন প্রখ্যাত শিল্পী মাস্টার ধনরাজের কাছে। বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র বাজাতে সিদ্ধহস্ত ছিলেন ধনরাজ। তাঁর কাছে তালিম নিয়ে নিজস্ব গানের দলও করেছিলেন দিলীপ। এ ছাড়া নিজের শহর চেন্নাইয়ের (তখন অবশ্য মাদ্রাজ) বিভিন্ন ব্যান্ডেও কিবোর্ড বাজাতেন। কিন্তু সংসারে অনটন থেকেই গিয়েছিল।

সমস্যার সুরাহার খোঁজে দিলীপের ধর্মপ্রাণ মা বিভিন্ন ধর্মস্থানে ছুটতেন। যদি কোথাও মনের শান্তি পাওয়া যায়। প্রথম থেকেই তাঁদের পরিবারে সব ধর্মের প্রতি সম্মান ও উদারতা বজায় ছিল।

জীবনের এমনই এক কঠিন সময়ে তাঁরা সুফিবাদের সংস্পর্শে আসেন। পূর্ব পরিচিত এক সুফিসাধক তাঁদের পাশে দাঁড়ান। তিনি নিজেও সে সময় বৃদ্ধ ও অসুস্থ। তিনি দিলীপের মা কস্তুরী ছিলেন তাঁর কন্যাসম। এই সুফিসাধকের প্রভাবে সমস্যা জর্জরিত পরিবারটি শান্তি খুঁজে পায়।

১৯৮৬ সালে, কস্তুরী তাঁর সন্তানদের নিয়ে ধর্মান্তরিত হন। তাঁর নতুন নাম হয় করিমা। নতুন নাম নিজে ঠিক করতে না পেরে দিলীপ গেলেন এক জ্যোতিষীর কাছে। তিনি গণনা করে বললেন, ‘আব্দুল রহমান’ বা ‘আব্দুল রহিম’-এর মধ্যে যে কোনও একটি নাম তাঁর জন্য শুভ হবে।

১৯ বছরের তরুণের পছন্দ হল ‘রহমান’ শব্দটা। তিনি ওটাই বেছে নিলেন। মা বললেন, তার আগে ‘আল্লারাখা’ কথাটা রাখতে। অর্থাৎ ঈশ্বর যাঁকে রক্ষা করেন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই তরুণ দিকপাল হয়ে উঠলেন। তাঁর নামটি সংক্ষিপ্ত হল “এ আর রহমান”। আজ, নামটি নিজেই একটি প্রতিষ্ঠান।

AR Rahman 7

সব ধর্মবিশ্বাসের প্রতি সম্মান এখনও তাঁর জীবনের মূলমন্ত্র। তাঁর সুরে বার বার ফিরে এসেছে সুফিগানের প্রভাব। খ্যাতির শীর্ষে পৌঁছেও এ আর রহমান নিজের কৃতিত্বের স্বীকৃতি দেন তাঁর মাকেই।

জীবনসঙ্গিনী খোঁজার সময়েও মায়ের উপর নির্ভরশীল ছিলেন রহমান। জানিয়ে দিয়েছিলেন নিজের পছন্দ। বলেছিলেন, তাঁর স্ত্রী যেন উচ্চশিক্ষিত হন। পরিস্থিতির চাপে নিজের স্কুলজীবন অসমাপ্ত থেকে গিয়েছিল। সেই আক্ষেপ রয়ে গিয়েছিল রহমানের।

তাই তিনি চেয়েছিলেন তাঁর স্ত্রী যেন শিক্ষিত হন। তবে একইসঙ্গে তাঁকে হতে হবে যথেষ্ট বিনয়ী। সে রকমই জানিয়েছিলেন রহমান। ছেলের পছন্দ অনুযায়ী পাত্রী খুঁজতে লাগলেন রহমানের মা।

এক দিন ধর্মস্থানে এক তরুণীকে দেখে বেশ ভাল লাগল রহমানের মায়ের। তিনি খোঁজ নিয়ে জানতে পারলেন তরুণীর নাম মেহর। তাঁর বাবা মায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করলেন করিমা। মেহরের বাবা ছিলেন চেন্নাইয়ের ব্যবসায়ী।

কিন্তু তিনি এই প্রস্তাবে রাজি হলেন না। বললেন, মেহরের দিদি সায়রা বানুর এখনও বিয়ে হয়নি। আগে সায়রার বিয়ে হবে। তার পর মেহরের পালা। শুনে প্রথমে কিছুটা হতোদ্যম হয়ে পড়লেও সায়রার সঙ্গে এক বার কথা বলতে চাইলেন করিমা।

সায়রা বানুকে দেখার পর করিমা বুঝলেন, তাঁর ছেলের পাশে এই তরুণী মেহরের থেকেও বেশি মানানসই। দুই বাড়ির সম্মতিতে ঠিক হল সম্বন্ধ। বিয়ের আগে দেখা হল আল্লারাখা এবং সায়রা-র।

AR Rahman 12

হবু স্ত্রীকে আল্লারাখা বললেন, এমনও হতে পারে রেস্তরাঁয় নৈশভোজে গিয়ে হঠাৎ তাঁর মাথায় কোনও গানের সুর এল। তিনি কিন্তু ডিনার ফেলে বাড়ি ফিরে বসে যাবেন গান নিয়ে। সায়রা কি রাজি আছেন তাঁকে বিয়ে করতে? সলজ্জ হেসে সম্মতি জানিয়েছিলেন সায়রা বানু।

১৯৯৫ সালের মার্চে বিয়ে হয় তাঁদের। তখন রহমানের বয়স ২৭ বছর। সায়রা ২১ বছরের তরুণী।

গত আড়াই দশক ধরে তারকা স্বামীর পাশে সায়রা বানু থেকেছেন তাঁদের যাত্রাপথের নৌকার হাল ধরে থেকে। দুই মেয়ে খাতিজা, রহিমা এবং ছেলে আমিনকে ঘিরে আবর্তিত হয় তাঁদের আনন্দ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Show Buttons
Hide Buttons
Translate »