নবীজির বাড়িতে দাওয়াত খেতে একদিন – মহান আল্লাহ পাক, রাসুলুল্লাহ (সা:)-কে মানবজাতির সর্বোত্তম আদর্শ ও শিক্ষক হিসেবে প্রেরণ করেন। তাঁর জীবনাদর্শের মাধ্যমে মানবজাতিকে মনুষ্যত্ব, মানবিকতা ও সভ্যতা শিখিয়েছিলেন। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘রাসুলের জীবনে তোমাদের জন্য রয়েছে উত্তম আদর্শ।’ (সুরা: আহজাব, আয়াত: ২১)।
মহানবী (সা:) ছিলেন সব গুণের আধার। আতিথেয়তা ছিল তাঁর জীবনের একটি অন্যতম প্রধান গুণ। সাধারণভাবেই আরব জাতি অতিথিপরায়ণ। জাহেলি যুগে পরম শত্রুও অতিথি হলে তাকে আরবরা অবলীলায় ক্ষমা করে দিত।
আরব জাতি-গোষ্ঠীর ভেতর কুরাইশের বনু হাশেম আতিথেয়তায় বিশেষ খ্যাতি ছিল। তাদের আতিথেয়তার স্বীকৃতিস্বরূপ তারা বংশপরম্পরায় হজ মৌসুমে হাজিদের পানি পান ও আপ্যায়নের দায়িত্ব পালন করে এসেছেন।
রাসুলুল্লাহ (সা:)ও শৈশবে দাদার সঙ্গে হাজিদের পানি পান করিয়েছিলেন। উদারতা ও আতিথেয়তায় রাসুলুল্লাহ (সা:) ছিলেন বংশীয় ধারারও অনেক ঊর্ধ্বে। তাঁর আতিথেয়তা ছিল প্রবাদতুল্য।
প্রথম ওহি নাজিলের পর রাসুলুল্লাহ (সা:) যখন নিজের ব্যাপারে ভীত হয়ে পড়েন, তখন খাদিজা (রা:) তাঁর অনন্য যেসব গুণাবলির উল্লেখ করেন তার মধ্যে আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা করা এবং আতিথেয়তার কথা উল্লেখ করেন।
খাদিজা (রা:) নবীজিকে আশ্বস্ত করে বলেন, ‘আল্লাহর শপথ! কখনোই না। আল্লাহ আপনাকে কখনো অপদস্থ করবেন না। নিশ্চয়ই আপনি আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করেন, দুর্বলের বোঝা বহন করেন, অসহায়কে সহায়তা করেন, অতিথিদের সম্মানজনক আপ্যায়ন করেন এবং সত্যের অনুসারীদের সাহায্য করেন।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৩)।
ঐতিহাসিক ও সিরাত গবেষকরা রাসুলুল্লাহ (সা:)-এর আতিথেয়তার নানা দিক তুলে ধরেছেন। সিরাতে ইবনে ইসহাকের বর্ণনা মতে, নবী কারিম (সা:) প্রত্যেক বছর রমজানে গারে হেরায় মোরাকাবা (ধ্যানমগ্ন হওয়া) করতেন। এই ধারাবাহিকতা শুরু থেকেই ছিল। মোরাকাবা শেষে তাওয়াফ করতেন এবং সমস্ত মিসকিনকে খানা খাওয়াতেন। (ইবনে হিশাম: ১/২৩৬)।
আল্লামা ইবনে ইসহাক (রহ:) এ কথাও বলেন, রাসুল (সা:)-এর ইবাদতে এটাও অন্তর্ভুক্ত ছিল যে কুরাইশের যেসব ফকির-মিসকিন তাঁর নিকট আসত তাদের খানা খাওয়াতেন। (সিরাতে ইবনে ইসহাক (উর্দু), পৃষ্ঠা ১২১)।
আল্লামা ইবনে ইসহাক (রহ:)-এর বর্ণনায় রয়েছে, রাসুলুল্লাহ (সা:) ইসলামের বাণী পৌঁছানোর উদ্দেশ্যে দুটি আপ্যায়নের ব্যবস্থা করেছিলেন। এতে আব্দুল মোত্তালিব গোত্রের প্রায় ৪০ জন ব্যক্তি উপস্থিত ছিলেন এবং তাঁরা পেটভরে খেয়েছিলেন।
পবিত্র কোরআনেও রাসুলুল্লাহ (সা:)-এর আতিথেয়তার একটি ঘটনা বিবৃত হয়েছে। এই ঘটনা থেকে অতিথিদের প্রতি রাসুলুল্লাহ (সা:)-এর মনোভাব যেমন স্পষ্ট হয়, তেমনি অতিথিদের জন্য রয়েছে শিক্ষা ও উপদেশ।
ইরশাদ হয়েছে, ‘হে মুমিনরা! তোমাদের অনুমতি দেওয়া না হলে খাদ্য-প্রস্তুত হওয়ার অপেক্ষা না করে খাওয়ার জন্য নবীর ঘরে প্রবেশ করবে না। তবে তোমাদের আহ্বান জানালে তোমরা প্রবেশ করবে। আর খাওয়া শেষে তোমরা চলে যেয়ো। তোমরা কথাবার্তায় লিপ্ত হয়ে যেয়ো না। কেননা তোমাদের এই আচরণ নবীকে কষ্ট দেয়। তিনি তোমাদের উঠিয়ে দিতে সংকোচবোধ করেন। কিন্তু আল্লাহ সত্য বর্ণনায় সংকোচবোধ করেন না।’ (সুরা আহজাব, আয়াত: ৫৩)।
এই আয়াত নাজিলের প্রেক্ষাপট একাধিক হাদিসে বর্ণিত হয়েছে। আনাস ইবনে মালিক (রা:) থেকে বর্ণিত দীর্ঘ এক হাদিসে বলা হয়েছে, ‘কোনো একজন স্ত্রীর সঙ্গে রাসুলুল্লাহ (সা.) বিয়ে অনুষ্ঠিত হলো। উম্মে সালমা (রা:) ‘হাইস’ (খেজুর, দুধ ও ঘির তৈরি খাবার) প্রস্তুত করলেন। তিনি তা আমাকে দিয়ে বললেন, এটা রাসুলুল্লাহ (সা:) এর কাছে নিয়ে যাও এবং আমার সালাম বলো। আর বলবে, এটা আমার পক্ষ থেকে তাঁর জন্য সামান্য উপহার।
আমি তা রাসুলুল্লাহ (সা:) এর কাছে নিয়ে গেলাম এবং উম্মে সালমা (রা:)-এর সালাম পৌঁছে দিলাম। রাসুলুল্লাহ (সা:) তা দেখে বললেন, রাখো এবং অমুক অমুক ব্যক্তিকে ডেকে নিয়ে এসো।
বেশ কয়েকজনের নাম বলার পর বললেন, ‘এ ছাড়া যেসব মুসলিমের সাক্ষাৎ তুমি পাবে।’ তিনি আমাকে যাদের নাম বলেছিলেন এবং যাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ হলো—আমি সবাইকে আমন্ত্রণ জানালাম।
ফিরে এসে দেখলাম, রাসুল (সা:)-এর বাড়ি, তাঁর কক্ষ ও সুফফা (মসজিদে নববীতে দ্বিনি শিক্ষার্থীদের থাকার স্থান) মানুষে পরিপূর্ণ। প্রায় ৩০০ লোক সেদিন উপস্থিত হন।
আমাকে রাসুলুল্লাহ (সা:) খাবারের পাত্র হাতে নিলেন, দোয়া করেন এবং বলেন, মাশাআল্লাহ! এরপর বলেন, যে ১০ ব্যক্তিকে ডাকা হবে তারা এসে খাবার গ্রহণ করবে। প্রত্যেকে যা পাবে তা-ই খাবে। এভাবে সবাই আহার করল।
রাসুলুল্লাহ (সা:) যখন পাত্রটি রেখে দিলেন তখন তাতে প্রথম অবস্থার চেয়ে বেশি খাবার ছিল। খাওয়া শেষ করার পর কিছু মানুষ রাসুলুল্লাহ (সা:) এর ঘরে বসে গল্প জুড়ে দিল। অথচ রাসুল (সা:) এর নববিবাহিতা স্ত্রী ঘরের ভেতর দেয়ালে দিকে মুখ করে বসেছিলেন। তারা আলাপচারিতা দীর্ঘায়িত করল। এতে রাসুল (সা:)-এর কষ্ট হচ্ছিল।
কিন্তু লজ্জাশীলতার জন্য কিছু বলতে পারছিলেন না। তিনি দাঁড়িয়ে তাঁর স্ত্রীর সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। তখন উপস্থিত লোকেরা রাসুল (সা:)-এর কষ্ট হচ্ছে বুঝতে পেরে ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন।
রাসুলুল্লাহ (সা:) ঘরে প্রবেশ করে পর্দা টেনে দিলেন। তখন আমি [আনাস (রা:)] ঘরেই ছিলাম। মহানবী (সা:) ঘরে কিছুক্ষণ অবস্থান করলেন। তখনই আয়াত নাজিল হলো। তিনি বের হয়ে মানুষকে তা শুনিয়ে দিলেন। (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১৪২৮)।
এই হাদিস থেকে রাসুলুল্লাহ (সা:) এর আতিথেয়তা ও উদারতা সম্পর্কে যেমন ধারণা পাওয়া যায়, তেমনি অতিথিদের কতিপয় করণীয়ও জানা যায়।
লেখক : সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা (সিসি), বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট, ঢাকা।