ঐতিহাসিক বিদায় হজের ভাষণ, যত পড়ি তত পড়তে ইচ্ছা করে !
শুক্রবার ৯ জিলহজ্ব ১০ হিজরি সন, হজ্জের সময় আরাফা ময়দানে দুপুরের পর হযরত মুহাম্মদ (স:) লক্ষাধিক সাহাবীর সমাবেশে এ ঐতিহাসিক বিদায় হজের ভাষণ দেন।
হামদ ও সানার পর তিনি বলেন: হে মানুষ! তোমরা আমার কথা শোনো, এর পর এই স্থানে তোমাদের সাথে আর একত্রিত হতে পারবো কিনা জানিনা!
হে মানুষ! আল্লাহ বলেন – হে মানবজাতি তোমাদেরকে আমি এক পুরুষ ও এক নারী থেকে সৃষ্টি করেছি এবং তোমাদেরকে সমাজ ও গোত্রে ভাগ করে দিয়েছি যেন তোমরা পরস্পরের পরিচয় জানতে পার। অতএব শুনে রাখো মানুষে মানুষে কোন ভেদাভেদ নেই ।
আরবের ওপর কোনো অনারবের, অনারবের উপর কোনো আরবের শ্রেষ্ঠত্ব নেই । তেমনি সাদার উপর কালোর বা কালোর উপর সাদার কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই । তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তিই আল্লাহর কাছে সবচেয়ে বেশী সম্মান ও মর্যাদার অধিকারী, যে আল্লাহকে ভালবাসে।
হে মানুষ ! শুনে রাখো অন্ধকার যুগের সকল বিষয় ও প্রথা আজ থেকে বিলুপ্ত হলো। জাহিলি যুগের রক্তের দাবিও রহিত করা হলো।
হে মানুষ ! শুনে রাখো, অপরাধের দায়িত্ব কেবল অপরাধীর ওপরই বর্তায় । পিতা তার পুত্রের জন্যে আর পুত্র তার পিতার অপরাধের জন্য দায়ী নয়।
হে মানুষ! তোমাদের রক্ত তোমাদের সম্মান তোমাদের সম্পদ পরস্পরের জন্য চিরস্থায়ী ভাবে হারাম অর্থাৎ পবিত্র ও নিরাপদ করা হলো যেমন আজকের এই মাস এই শহর সকলের জন্য পবিত্র ও নিরাপদ।
হে মানুষ! তোমরা ঈর্ষা ও হিংসা-বিদ্বেষ থেকে দুরে থাকবে। ঈর্ষা ও হিংসা মানুষের সকল সৎগুনকে ধ্বংস করে।
হে মানুষ! নারীদের সম্পর্কে আমি তোমাদের সতর্ক করে দিচ্ছি, তাদের সাথে নিষ্ঠুর আচরণ করোনা, তাদের উপর যেমন তোমাদের অধিকার রয়েছে তেমনি তোমাদের উপর তাদেরও অধিকার রয়েছে সুতরাং তাদের কল্যাণের দিকে সবসময় খেয়াল রেখো।
হে মানুষ! অধীনস্থদের সম্পর্কে সতর্ক হও। তোমরা নিজেরা যা খাবে তাদেরও তা খাওয়াবে। নিজেরা যা পরবে তাদেরও তা পরাবে। শ্রমিকের শরীরের ঘাম শুকানোর আগেই তার মজুরি পরিশোধ করবে।
হে মানুষ! বিশ্বাসী সেই ব্যক্তি যার হাত ও মুখ থেকে অন্যের সম্মান,ধন ও প্রাণ নিরাপদ। সে নিজের জন্য যা পছন্দ করে অন্যের জন্যেও তাই পছন্দ করে ।
হে মানুষ! বিশ্বাসীরা পরস্পরের ভাই। সাবধান! তোমরা একজন আরেকজনকে হত্যা করার মতো কুফরি কাজে লিপ্ত হয়ো না।
হে মানুষ! শুনে রাখো আজ হতে বংশগত শ্রেষ্ঠত্ব বা কৌলিনপ্রথা বিলুপ্ত করা হলো কুলীন বা শ্রেষ্ঠ সেই যে বিশ্বাসী ও মানুষের উপকার করে।
হে মানুষ! ঋণ অবশ্যই ফেরত দিতে হবে, বিশ্বস্ততার সাথে প্রত্যেকের আমানত রক্ষা করতে হবে,কারো সম্পত্তি সে যদি স্বেচ্ছায় না দেয়, তবে তা অপর কারো জন্য হালাল নয় । তোমরা কেউ দুর্বলের উপর অবিচার করো না।
হে মানুষ! জ্ঞানীর কলমের কালি শহীদের রক্তের চেয়েও মূল্যবান। জ্ঞান অর্জন প্রত্যেক নর-নারীর জন্য ফরয, কারণ জ্ঞান মানুষকে সঠিক পথ দেখায় ।
হে মানুষ! তোমরা তোমাদের প্রভুর ইবাদত কর, নামায কায়েম কর, যাকাত আদায় কর, রোজা রাখ, হজ্ব আদায় কর আর সংঘবদ্ধ ভাবে নেতাকে অনুসরণ কর, তাহলে তোমরা জান্নাতে দাখিল হতে পারবে।
হে মানুষ! শুনে রাখো – একজন কুশ্রী-কদাকার ব্যক্তিও যদি তোমাদের নেতা মনোনীত হয়, যতদিন পর্যন্ত সে আল্লাহর কিতাব অনুসারে তোমাদের পরিচালিত করবে, ততদিন পর্যন্ত তার আনুগত্য করা তোমাদের অবশ্য কর্তব্য।
হে মানুষ ! শুনে রাখো আমার পর আর কোনো নবী নেই । হে মানুষ আমি তোমাদের কাছে দুটি আলোকবর্তিকা রেখে যাচ্ছি। যতদিন তোমরা এ দুটো অনুসরণ করবে ততদিন তোমরা সত্য পথে থাকবে। এর একটি হলো “আল্লাহর কিতাব”, দ্বিতীয়টি হলো “আমার জীবন দৃষ্টান্ত”।
হে মানুষ! তোমরা কখনোই ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করো না, কারন অতীতে বহু জাতি ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ির কারনে ধ্বংস হয়ে গেছে।
হে মানুষ! প্রত্যেককেই শেষ বিচারের দিনে সকল কাজের হিসেব দিতে হবে । অতএব, সাবধান হও।
হে মানুষ! তোমরা যারা এখানে হাজির আছো,আমার এই বাণীকে সবার কাছে পৌঁছে দিও। এরপর তিনি জনতার উদ্দেশ্যে জিজ্ঞেস করলেন – হে মানুষ আমি কি তোমাদের কাছে আল্লাহর বাণী পৌঁছে দিয়েছি ? সকলে সমস্বরে জবাব দিলো – হ্যাঁ। এরপর নবীজী (স:) বললেন হে আল্লাহ তুমি সাক্ষী থাকো, আমি আমার সকল দায়িত্ব পালন করেছি ।