পৃথিবী শাসন করা বীরদের নাম নিলে প্রথমেই উঠে আসবে আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট, চেঙ্গিস খান, কুবলাই খান, জুলিয়াস সিজার, তৈমুর লং সহ বহু শাসকের নাম।
কিন্তু অন্যান্য শাসকদের ন্যায় তৈমুর কোনো রাজপরিবারের সন্তান ছিলেন না। সামান্য ভূস্বামীর সন্তান তৈমুর ধীরে ধীরে ক্ষমতার শীর্ষে আরোহণ করেছেন, হয়েছেন বিশ্বজয়ী বীর।
তৈমুর তার নিষ্ঠুরতার জন্য অন্যান্য শাসকদের নিকট ছিলেন এক মূর্তিমান আতংক। এমনকি মৃত্যুর পরেও তিনি পৃথিবীকে জানান দিয়ে গেছেন তার ফিরে আসার কথা।
১৪০৫ সালের জানুয়ারি মাস। কাজাখস্তান জুড়ে নেমে এসেছে অসহনীয় শীত। প্রবল তুষারপাতে সমস্ত পথঘাট চলাচলের অনুপযুক্ত হয়ে পড়েছে। শীতের তীব্রতায় পথের ধারে মরে পড়ে আছে পশুপাখির দল।
এমন বৈরী পরিবেশে একদল অভিযাত্রীর দেখা মিললো চীনের দিকে অগ্রসররত অবস্থায়। সৈন্যসামন্ত, হাতি, ঘোড়া বোঝাই সেই দলটি তাদের অধিপতি তৈমুরের নেতৃত্বে এগিয়ে যাচ্ছে চীন দখলের উদ্দেশ্যে।
তৈমুর, যার নাম শুনলে পৃথিবীর যেকোনো রাজার সিংহাসন থর থর করে কাঁপে, তার পরিস্থিতিও বেশ সুবিধাজনক না। তার উপরে আজ সকাল থেকে তার শরীরের তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি বেড়ে গেছে।
দলের কবিরাজরা তৈমুরকে পরীক্ষা করেন। তাদের চোখে মুখে ফুটে উঠে শঙ্কার ছাপ। এই মুহূর্তে পিছু না হটলে তৈমুরকে বাঁচানো সম্ভব নয়। কিন্তু তৈমুর নাছোড়বান্দা। রাগে গজ গজ করে উঠেন তিনি।
শেষপর্যন্ত কাজাখস্তানের শীতের কাছে পরাস্ত হবেন! তিনি তার সিদ্ধান্তে অটল, “পিছু হটা চলবে না। তৈমুর কখনও পিছু হটতে পারে না”। হাকিম নড়ে তো হুকুম নড়ে না।
তাই শত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও এগিয়ে চললো তৈমুর বাহিনী। কিন্তু পথিমধ্যে শত শত সৈনিক মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লো। তৈমুরের নিজের অবস্থারও দিন দিন অবনতি হতে থাকলো।
শেষ পর্যন্ত তৈমুর হার মানলেন। কাজাখস্তানের ওতরার পর্যন্ত এসে ভেঙে পড়লেন তৈমুর। শীতের কারণে পিছু হটাও অসম্ভব হয়ে উঠলো।
শেষপর্যন্ত ফেব্রুয়ারির ১৮ তারিখ সকালে কাজাখস্তানের শীতের থাবায় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন এশিয়ার ত্রাস তৈমুর লং। পৃথিবীর রাজাধিরাজরা যা করতে পারেননি, তা করে দেখালো সামান্য শীত!
দাফনের উদ্দেশ্যে তৈমুরকে সমরকন্দে ফিরিয়ে আনা হলো। শেষ ইচ্ছানুযায়ী তার কবরে বড় বড় অক্ষরে লিখে দেয়া হলো, “আমি যেদিন ফের জেগে উঠবো, সেদিন সমগ্র পৃথিবী আমার ভয়ে কাঁপবে!”
কেশ শহরের দূরন্ত শিশু তৈমুরের বেড়ে ওঠা:
১৩৩৬ সালের কথা। গভীর রাত। উজবেকিস্তানের প্রতিটি ঘরের বাতি নিভে গেছে। গভীর ঘুমে বিভোর উজবেকবাসী। কিন্তু ঘুম নেই শুধু একটি ঘরে। সমরকন্দ থেকে প্রায় ৫০ মাইল দূরে অবস্থিত কেশ নগরীর স্কারদু শহরের সবচেয়ে বড় বাড়িতে এখনও নিভু নিভু অবস্থায় প্রদীপ জ্বলছে। ঘরের বাইরে উঠানে অস্থির পায়চারি করছেন বাড়ির মালিক তারাগে।
তিনি এই অঞ্চলের ভূস্বামী। হঠাৎ তার স্ত্রীর প্রসব বেদনা ওঠায় তিনি চিন্তিত। শহরে লোক পাঠানো হয়েছে ধাত্রীর খোঁজে, কিন্তু তারা এখনও ফিরে আসেনি। মনে মনে সৃষ্টিকর্তার নিকট প্রার্থনা করছেন তিনি।
শেষপর্যন্ত তার ডাকে সাড়া দিলেন সৃষ্টিকর্তা। ভোরের প্রথম আলোর সাথে ভূমিষ্ঠ হলো এক পুত্রসন্তান। পুত্রের নাম রাখা হলো ‘তৈমুর’, যার অর্থ ‘লৌহ’। ইউরোপে তিনি ‘তিমুর’ (Timur) বা ‘তিমুরলেন’ (Timurlane) নামে পরিচিত।
হয়তো তার নামকরণের সার্থকতা প্রমাণের জন্যই তৈমুর বেশ দুরন্ত এবং সাহসী কিশোর হিসেবে বেড়ে ওঠেন। এমনকি ছোটখাট ডাকাত বাহিনীও গড়ে তুলেন তিনি। এলাকা ঘুরে ঘুরে ছোটখাট জিনিস লুট করে বেড়াতো তারা।
দেখতে দেখতে তৈমুর যৌবনে পদার্পণ করেন। বয়সের সাথে সাথে তার শক্তি এবং সাহস, দুটোই বৃদ্ধি পেয়েছে। এবার সত্যিকারের দস্যুদল গঠন করেন তিনি।
তৈমুরের দাপটে এলাকার ধনীরা আতংকিত হয়ে থাকতো। যুবক তৈমুরের ডান পা এক দুর্ঘটনায় পঙ্গু হয়ে যায়। কিন্তু ঠিক কীভাবে তিনি খোঁড়া হয়েছিলেন, তা সঠিকভাবে জানা যায়নি।
একদল ইতিহাসবিদের মতে, একবার তৈমুর তার দলবল নিয়ে এক বণিকের ভেড়ার পাল লুট করতে যান। কিন্তু ফেরার পথে তৈমুর রাখালদের তীরের আঘাতে মারাত্মকভাবে জখম হন।
তার ডান হাত এবং ডান পা চিরতরে অকেজো হয়ে যায়। এরপর থেকে তিনি ‘খোঁড়া তৈমুর’ বা ‘তৈমুর-ই-লং’ নামে পরিচিত হন।
তৈমুর লং এর উত্থান:
এক পা খোঁড়া হয়ে গেলেও তৈমুর দমে যাননি। আহত বাঘের মতো আরও হিংস্র হয়ে ওঠেন তিনি। তৈমুরের সময়ের প্রায় একশত বছর পূর্বে চেঙ্গিস খান পুরো পৃথিবীর শাসন করেছিলেন।
তৈমুর মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন, তিনিও চেঙ্গিসের মতো পৃথিবী শাসন করবেন। তাই খোঁড়া পা নিয়ে সমরবিদ্যার প্রশিক্ষণ নেন তিনি। কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে তিনি অস্ত্র চালনায় বেশ পারদর্শী হয়ে ওঠেন।
তৈমুর যখন টগবগে যুবক, তখন সমগ্র মধ্য এশিয়া (আমু দরিয়া এবং সির দরিয়া নদীবিধৌত অঞ্চল) জুড়ে ক্ষমতার দ্বন্দ্বে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা তৈরি হয়। বিভিন্ন যাযাবর দল এবং স্থানীয় নেতাদের মধ্যে প্রায়ই যুদ্ধ লেগে থাকতো।
অপরদিকে স্থানীয় নেতারা অনেকটা পশ্চিমা মতাদর্শে শাসন করতেন। তারা চেঙ্গিস খান, কুবলাই খানের শাসনব্যবস্থা পরিত্যাগ করেছিলেন। এই কারণে স্থানীয় জনগণ তাদের উপর অসন্তুষ্ট ছিল।
১৩৪৭ সালে আমির কাজগান স্থানীয় নেতা চাগতাই খানাতের সর্দার বরলদেকে হটিয়ে নিজে ক্ষমতা দখল করেন। কিন্তু ১৩৫৮ সালে তিনি ঘাতকের হাতে নিহত হন।
এবার ক্ষমতায় আসেন তুঘলক তিমুর। তিনি বারলাস অঞ্চলের শাসক হিসেবে তৈমুর লংকে নিযুক্ত করেন। তৈমুর ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকেই তুঘলককে অপসারণ করার নীলনকশা তৈরি করতে থাকেন।
কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে তিনি ধরা পড়ে যান। তুঘলক তিমুর তৈমুরকে ক্ষমতাচ্যুত করেন। এবার তৈমুর লং স্বয়ং আমির কাজগানের নাতি আমির হুসেইনের সাথে হাত মেলান।
তৈমুর হুসেইনের বোনকে বিয়ে করেন। তারা দুজন মিলে ১৩৬৪ সালে তুঘলক তিমুরের পুত্র আমির খোজাকে পরাজিত করে মধ্য এশিয়ার সিংহাসনে বসেন। তৈমুর এবং হুসেইন যৌথভাবে শাসন করতে থাকেন। কিন্তু তৈমুর সন্তুষ্ট ছিলেন না। তিনি হুসেইনকে হটিয়ে দেয়ার সুযোগ খুঁজতে থাকেন।
এদিকে ১৩৭০ সালে তৈমুরের স্ত্রী মৃত্যুবরণ করেন। এই মৃত্যু তৈমুরের জন্য শাপে বর হয়ে আসে। এবার আর হুসেইনের সাথে কোনো পারিবারিক বন্ধন থাকলো না। তৈমুর আমির হুসেইনকে হত্যা করে নিজেকে মধ্য এশিয়ার একচ্ছত্র অধিপতি হিসেবে ঘোষণা করেন। শুরু হয় তৈমুর লং এর শাসন।
সাম্রাজ্য সম্প্রসারণ:
তৈমুর মঙ্গোল সাম্রাজ্যের খান হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু চেঙ্গিস খানের সাথে পারিবারিক সম্পর্ক না থাকায় তিনি মঙ্গোলদের আমির হিসেবে শাসন করেন। তিনি রণকৌশলে অত্যন্ত পারদর্শী ছিলেন।
তাই ক্ষমতা লাভের কয়েক বছরের মাথায় অনায়াসেই পুরো মধ্য এশিয়ার অধিপতি হয়ে যান। কিন্তু তৈমুর আরও চান। তিনি চেঙ্গিসের মতো পৃথিবী শাসন করতে চান।
তৈমুর তার সামনে চেঙ্গিস খানের মানচিত্র মেলে ধরেন। পুরো মানচিত্রে একবার চোখ বুলিয়ে নেন তিনি। এতে তার বিশ্বজয়ের আকাঙ্ক্ষা আরো বেড়ে গেলো। পরদিনই তিনি বিশাল সেনাবহর নিয়ে বিশ্বজয়ে বের হন।
তৈমুরের অভিযানের খবর পেয়ে ক্ষমতাচ্যুত মঙ্গোল খান তোকতামিশ তৈমুরের সাহায্য প্রার্থনা করেন। তোকতামিশ খান শত্রুদের হাতে রাশিয়ার মসনদ হারিয়েছিলেন।
তৈমুর লং বিশাল সেনাবহর নিয়ে রাশিয়া আক্রমণ করেন এবং তোকতামিশ খানকে রাশিয়ার হৃত সিংহাসন ফিরিয়ে দেন। এরপরই তৈমুর পারস্যের দিকে রওয়ানা হন। তৈমুরের পারস্য অভিযান শুরু হয় হেরাত নগরী দখলের মাধ্যমে।
প্রথমদিকে কার্তিদ সাম্রাজ্যের রাজধানী হেরাত তৈমুরের নিকট আত্মসমর্পণ করতে অপারগতা প্রকাশ করে। তৈমুর যেন এই সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন। তিনি হেরাতের সকল নাগরিককে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করার আদেশ দেন।
আদেশ পাওয়া মাত্র তৈমুরবাহিনী হেরাতবাসীর উপর চড়াও হয়ে ওঠে। তৈমুর বাহিনীর আগ্রাসনে মৃত্যু-নগরীতে পরিণত হয় হেরাত। শেষপর্যন্ত ১৩৮৩ সালে হেরাত তৈমুরের পায়ে লুটিয়ে পড়ে পরাজয় স্বীকার করে।
এরপর তৈমুর তার বাহিনী নিয়ে আরো পশ্চিমে অগ্রসর হতে থাকেন। ততদিনে তৈমুরের নৃশংসতার খবর পারস্যের ঘরে ঘরে পৌঁছে গেছে। তৈমুর তেহরানের মাটিতে পা দিলেন। তেহরান নির্দ্বিধায় তৈমুরের নিকট আত্মসমর্পণ করে। ধীরে ধীরে এশিয়া মাইনর, সিরিয়া, আফগানিস্তান এবং ইরাকের কিছু অংশ তৈমুরের দখলে চলে আসে।
তৈমুর যখন দেশ দখলে ব্যস্ত, তখন তার কানে খবর পৌঁছে, বিভিন্ন অঞ্চলের নেতারা তৈমুরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছেন। ক্রুদ্ধ তৈমুর অভিযান ক্ষান্ত দিয়ে কঠোর হাতে বিদ্রোহ দমন করেন। আফগানিস্তানে বিদ্রোহীদের হত্যা করার পর তিনি একটি মিনার নির্মাণ করেন। মিনার নির্মাণের সরঞ্জাম ছিল বিদ্রোহীদের মস্তক।
ইস্পাহান শহরের ৭০ হাজার বিদ্রোহীর মাথার খুলি একটি অপরটির উপর জুড়ে দিয়ে মিনার তৈরি করা হয়। এভাবে ১৩৮৫ সালে পুরো পারস্য তৈমুরের দখলে চলে আসে।
১৩৮৭ সালে তৈমুরের মিত্র তোকতামিশ মধ্য এশিয়া আক্রমণ করে বসেন। নিজের ঘর বাঁচাতে তৈমুর নিজ অঞ্চলে ফিরে আসেন। তৈমুরের বিশাল বাহিনীর হাতে পরাজয় ঘটে তোকতামিশ খানের। তোকতামিশ খান রাশিয়ায় ফেরত যান।
তৈমুর ১৩৯২ সালে পুনরায় পশ্চিমে অভিযান চালান এবং ইরাক দখল করে নেন। মঙ্গোল খানদের গৌরব ‘গোল্ডেন হোর্ড’ বা ‘ইলখানাত‘ তৈমুরের নিকট অসহায় পরাজয় বরণ করে। তৈমুরের পূর্বে কেউ ইলখানাত ধ্বংস করতে পারেনি।
এবার তিনি রাশিয়ার দিকে অগ্রসর হন। তেরেক নদীর তীরে তোকতামিশ খান এবং তৈমুর ফের যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন। এবারও তৈমুরের কাছে পরাজিত হন তিনি। তৈমুর ১৩৯৫ সালে মস্কো দখল করেন।
অগ্নিস্নাত মস্কোর সামনে দাঁড়িয়ে তৈমুর তৃপ্তির হাসি দেন। তবে তার ক্ষুধা তখনও মিটেনি। সেদিনই মনে মনে ছক কষতে থাকেন তৈমুর। এবার ভারতবর্ষ জয়ের পালা।
ভারতবর্ষে তৈমুর:
ভারতবর্ষ আজীবন তৈমুরকে মনে রাখবে তার নৃশংসতার জন্য। ভারতবর্ষের অধিপতি ফিরোজ শাহের মৃত্যুর পর ক্ষমতার দ্বন্দ্বে বিভিন্ন নেতারা অন্তর্দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন। চতুর তৈমুর এই সুযোগ হাতছাড়া করতে চাইলেন না।
১৩৯৮ সালের শেষের দিকে প্রায় ৯০ হাজার সৈন্য নিয়ে সিন্ধু নদের পাড়ে হাজির হন তৈমুর লং। দূর থেকে দেখে ভয় পেয়ে যায় ভারতবাসী। যেন তৈমুর নয়, সাক্ষাত যমদূত তার বাহিনী নিয়ে হাজির হয়েছেন।
সিন্ধু নদ পাড়ি দিয়েই তৈমুর হত্যাযজ্ঞে মেতে ওঠেন। নির্বিচারে সাধারণ মানুষ হত্যা করতে করতে দিল্লীর দিকে অগ্রসর হতে থাকেন তৈমুর। প্রায় এক লাখ মানুষ হত্যার পরে তিনি দিল্লী গিয়ে পৌঁছান। দিল্লীর সুলতান নাসিরুদ্দিন শাহ তুঘলক হস্তিবাহিনী নিয়ে তৈমুরকে আক্রমণ করে বসেন।
বুদ্ধিমান তৈমুর এবার নতুন কৌশল অবলম্বন করলেন। হাজার হাজার উটের পিঠ খড়ের গাদা দিয়ে বোঝাই করলেন। এরপর খড়ের গাদায় আগুন লাগিয়ে উটগুলোকে হস্তিবাহিনীর দিকে হটিয়ে দেন। সুলতানের হস্তিবাহিনী জ্বলন্ত উটের আগ্রাসনে ভয় পেয়ে যায়। অবস্থা হিতে বিপরীত হয়ে যায়। হাতিগুলো উল্টো ঘুরে সুলতানকেই আক্রমণ করে বসে।
নিজেদের বাহিনীর হাতেই পরাজিত হন সুলতান। দিল্লী দখলের আনন্দে তৈমুর বাহিনী দিল্লী জুড়ে রক্তের বন্যা বসিয়ে দেয়। তৈমুর ভারতবর্ষ শাসন করেননি। তিনি ভারতবর্ষ থেকে বহু মূল্যবান সম্পদ লুট করে সমরকন্দে নিয়ে যান।
ভারত অভিযানরত অবস্থায় তৈমুর বাগদাদের দখল হারানোর দুঃসংবাদ লাভ করেন। ১৩৯৯ সালে তৈমুর পুনরায় বাগদাদ আক্রমণ করেন। বরাবরের মতোই তিনি অনায়াসে বাগদাদ দখল করে নেন। এবার তৈমুরের নিষ্ঠুরতা যেন আরো বেড়ে গেলো। তার আদেশে বাগদাদের ২০ হাজার বিদ্রোহীর শিরশ্ছেদ করা হয়।
অটোমান সাম্রাজ্যে তৈমুর থাবা:
অটোমান সাম্রাজ্য তৎকালীন যুগে পৃথিবীর অন্যতম শক্তিশালী সাম্রাজ্য ছিল। তৈমুরের নিষ্ঠুরতার সংবাদে অটোমান সুলতান বায়েজিদ ক্রোধান্বিত হন। তিনি তৈমুরকে সতর্ক করে বার্তা প্রেরণ করেন।
কিন্তু এর মাধ্যমে তিনি তার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল করে ফেলেন। বার্তা পাওয়া মাত্র তৈমুর মনস্থির করেন, অটোমানদের গৌরব মাটিতে মিশিয়ে দিবেন।
১৪০১ সালে তৈমুর তুরস্কের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন। সুলতান বায়েজিদ এই সংবাদে বিশাল বাহিনী নিয়ে প্রস্তুত হয়ে যান। ১৪০২ সালে তুরস্কের রাজধানী আঙ্কারায় দুই বাহিনী মুখোমুখি হয়।
সেদিন পুরো পৃথিবী তৈমুরের রণকৌশলে মুগ্ধ হয়ে যায়। শক্তিশালী অটোমান সাম্রাজ্য তৈমুরের নিকট শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। যুদ্ধে সুলতান বায়েজিদ বন্দী হন। পরবর্তীতে তিনি বন্দী অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন।
এই যুদ্ধের পর মিশর সাম্রাজ্য তৈমুরের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে। অটোমান সাম্রাজ্য ইউরোপের বহু রাষ্ট্রের জন্য হুমকিস্বরূপ ছিল। তৈমুরের অটোমান জয়ের ফলে ফ্রান্স, স্পেন সহ প্রভৃতি রাষ্ট্র তৈমুরের সাথে মিত্রতার সম্পর্ক স্থাপন করে।
প্রায় অর্ধেক পৃথিবী তৈমুরের দখলে চলে আসে। চেঙ্গিস খানকে আদর্শ মানা তৈমুর বীরদর্পে তার সাম্রাজ্যে পদচারণ করেন। দেশে দেশে ছড়িয়ে পড়ে তৈমুরের বীরত্বগাথা। স্বাধীন সম্রাটরা ভয়ে ভয়ে থাকেন। এই বুঝি তৈমুর তার বাহিনী নিয়ে আক্রমণ করে বসেন!
অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ তথ্য:
বিভিন্ন গ্রন্থ এবং ঐতিহাসিক পাণ্ডুলিপিতে তৈমুর সম্পর্কিত বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য লিপিবদ্ধ করা আছে। বেশ কিছু তথ্য নিয়ে ইতিহাসবিদগণ দ্বিমত প্রকাশ করলেও অধিকাংশ তথ্যই তৈমুরের ব্যক্তিগত জীবন দর্শনকে উপলব্ধি করার জন্য অপরিহার্য। বহু তথ্যের ভিড় থেকে বাছাই করা কয়েকটি উল্লেখযোগ্য তথ্য নিচে তুলে ধরা হলো:
- কঠোর তৈমুর ব্যক্তিগত জীবনে একজন শিল্পানুরাগী ছিলেন। তার পৃষ্ঠপোষকতায় পৃথিবীজুড়ে বিভিন্ন দৃষ্টিনন্দন ইমারত ও ভাস্কর্য নির্মিত হয়।
- তৈমুরের পঙ্গুত্ব নিয়ে দ্বিধার অবসানের উদ্দেশ্যে ১৯৪১ সালে এক রুশ প্রত্নতাত্ত্বিক তৈমুরের সমাধিক্ষেত্র খনন করেন। গবেষণায় তৈমুরের কোমরের বেশ কিছু স্থানে হাড়ের অসারতা এবং ডান হাতে দু’টি আঙুলের হাড় ভাঙা অবস্থায় পাওয়া যায়।
- তৈমুরের কফিনের ঢালায় বড় করে লেখা ছিল, “যে আমার কবর খনন করবে, সে আমার চেয়েও ভয়াবহ এক শাসককে জাগিয়ে তুলবে” এবং “আমি যেদিন ফের জেগে উঠবো, সেদিন সমগ্র পৃথিবী আমার ভয়ে কাঁপবে!”
- তৈমুরকে পুনরায় দাফন করার কিছুক্ষণের মধ্যেই রুশ বাহিনী স্টালিনগ্রাডে হিটলারের উপর জয় লাভ করে।
- তৈমুর বাহিনী প্রায় ১৭ মিলিয়ন মানুষ হত্যা করে, যা তৎকালীন পৃথিবীর জনসংখ্যার প্রায় ৫%।
- তৈমুর নিজেকে ‘ইসলামের তরবারি’ হিসেবে জাহির করেন। কিন্তু ইতিহাসবিদগণ তার ব্যক্তিগত ধর্ম বিশ্বাস সম্পর্কে কোনো প্রমাণ পাননি। ইতিহাসবিদদের মতে, তিনি ইসলামকে স্রেফ ক্ষমতা প্রয়োগের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করেছেন।
- তৈমুর লং তার আদর্শ চেঙ্গিস খানের ন্যায় শত্রুর দুর্বলতার সুযোগে আক্রমণ করতেন। রণকৌশলের ক্ষেত্রে তৈমুর অত্যন্ত চৌকস ছিলেন।