কথায় আছে, পান্তা ভাতের জল, তিন পুরুষের বল! হ্যা সত্যি তাই পান্তা শরীরের জন্য খুবই উপকারী। কারণ বলিষ্ঠ শরীর এবং নিজেকে সুষ্ঠু রাখতে পান্তা ম্যাজিকের মত কাজ করে থাকে।
১২ ঘণ্টা ভাত ভিজিয়ে রাখলে ১০০ গ্রাম পান্তায় ৭৩.৯১ মিলিগ্রাম আয়রন তৈরি হয়। আর সেই সম পরিমাণ গরম ভাতে আয়রন থাকে মাত্র ৩.৪ মিলিগ্রাম।
এছাড়া আমেরিকার নিউট্রিশিয়ান অ্যাসোসিয়েশনের গবেষণা জানাচ্ছে ভাত পানিতে ভিজিয়ে রাখলে পাকস্থলীর প্যানক্রিয়াটিক অ্যামাইজেল সহ আরও কিছু এনজাইমের কার্যকারিতা বহুগুণ বেড়ে যায়। দেহের বহু উপকারী ব্যাকটেরিয়া পান্তা ভাতে তৈরি হয়।
পান্তা ভাত এর ইতিহাসঃ
মুঘল শাসনামলে সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের সদস্যরা মুক্ত অনুষ্ঠানের আয়োজন করতো, আগত দর্শক শ্রোতাগণ ঐতিহ্যবাহী পান্তাভাত খেতো। বিংশ শতাব্দীর শেষ পাদে শহুরে বাঙালী বাংলা নববর্ষকে ঘটা করে উদ্যাপন শুরু করে। এই দিন বাঙালিয়ানার প্রতীক হিসেবে ভাজা ইলিশ মাছ সহযোগে পান্তা ভাত খাওয়া রেওয়াজে পরিণত হয়। একুশ শতাব্দীর প্রথম দশকে নববর্ষের সকালে ইলিশ মাছ সহযোগে পান্তা ভাত বাঙালি সংস্কৃতির অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়।
পান্তা ভাত এর পুষ্টিগুণঃ
- পান্তা ভাতের ক্যালরি মূল্য নির্ভর করে কি ধরনের চাল দিয়ে রান্না করা হয়েছে তার উপর। চাল ভেদে ১ কাপ ভাত থেকে ২০০- ২৪২ ক্যালরি পাওয়া যায়।
- পান্তা ভাতে আয়রন, ক্যালসিয়াম, পটাসিয়ামের পরিমাণ রান্না করা ভাতের তুলনায় বেশি থাকে। এছাড়া ভিটামিন -বি ২ , ভিটামিন -বি ১২ অপেক্ষাকৃত বেশি থাকে। অন্যদিকে সোডিয়ামের পরিমাণ কমে যায়। যা স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী।
- পান্তা ভাত দেহে পর্যাপ্ত পানি সরবরাহ করে দেহকে পানিশূন্যটা থেকে রক্ষা করে। তীব্র গরমে সান-স্ট্রোক বা হিট-স্ট্রোক থেকে রক্ষা করে। পান্তা গ্যাস্টিক রোগীর জন্যও উপকারী।
- গরম ভাতের চেয়ে পান্তায় পুষ্টি বেশি। গরম ভাতের তুলনায় পান্তা সহজে হজম হয়। গরম ভাতের চেয়ে পান্তায় সোডিয়াম কম থাকায় রক্তচাপ স্বাভাবিক থাকে, তবে এর সাথে লবণ বেশি নেওয়া যাবে না।
- ভাতে পানি দিয়ে রাখলে বিভিন্ন গাজনকারি ব্যাক্টেরিয়া বা ইস্ট শর্করা ভেঙে ইথানল ও ল্যাকটিক অ্যাসিড তৈরি করে। গাজনকারি ব্যাক্টেরিয়া যে ল্যাকটিক অ্যাসিড তৈরি করে এর ফলে পান্তা ভাতের অম্লত্ব বেড়ে যায়। তখন পচনকারী ও অন্যান্য ক্ষতিকারক ব্যাক্টেরিয়া, ছত্রাক ভাত নষ্ট করতে পারে না।
পান্তা ভাতের উপকারিতাঃ
♦ আমরা যে সাধারন চাল সিদ্ধ করে ভাত রান্না করি তার মধ্যে ফাইটিক এসিড থাকে যা বিভিন্ন খনিজ লবন যেমন-লৌহ, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, জিংক ইত্যাদির সঙ্গে যুক্ত থাকে এবং যা এইসমস্ত খনিজ লবণকে দেহে শোষনে বাধা দেয়। কিন্তু যখন ভাতকে সারা রাত ভিজিয়ে রাখা হয় তখন ভাতের শর্করা গাঁজনের ফলে ল্যাকটিক এসিড তৈরি হয় যা ভাতের সকল খনিজ লবণকে হাজার গুণ বাড়িয়ে দেয়।
♦ ১০০ গ্রাম ভাতকে ১২ ঘণ্টা পানিতে ভিজিয়ে পান্তাভাত তৈরি করলে তাতে লৌহ বা আয়রনের পরিমাণ ৩.৪ মিলিগ্রাম থেকে ৭৩.৯১ মিলিগ্রাম হয়। যাদের রক্তস্বল্পতা আছে তাদের জন্য পান্তাভাত খুবই উপকারি।
♦ ১০০ গ্রাম ভাতে ক্যালসিয়ামের পরিমাণ ২১ মিলিগ্রাম থাকে যা পান্তা ভাতে ৮৫০ মিলিগ্রাম হয়ে যায়। যাদের হাড় ক্ষয় রোগ বা দেহে ক্যলসিয়ামের অভাব আছে তারা খেতে পারেন পান্তা।
♦ পান্তা ভাতে পটাসিয়াম বেড়ে ৮৩৯ মিলিগ্রাম হয়। ফলে যাদের হৃদরোগ আছে বা যাদের উচ্চ রক্ত চাপ আছে তাদের জন্য পান্তা উপকারী।
♦ পান্তা ভাতে সোডিয়ামের পরিমাণ কমে ৪৭৫ মিলিগ্রাম থেকে ৩০৩ মিলিগ্রাম হয়। জিংকের পরিমাণও বেড়ে যায় অনেক গুণ। যেকোন মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য ভাল।
♦ সকালের নাস্তার জন্য খুবই ভাল খাবার পান্তা। কারণ পান্তা ভাত শরীরের অম্ল ও ক্ষারের সমতা রক্ষা করে। শরীরকে ঠান্ডা রাখে। এক কাপ চা বা কফির চেয়ে শরীরের জন্য অনেক ভাল একপ্লেট পান্তা ভাত।
♦ পান্তা ভাত ভিটামিন বি৬ এবং বি১২ এর ভাল উৎস যা রক্ত তৈরিতে সাহায্য করে এবং অন্য কোন খাবারে এত সহজে এত পরিমাণে এই ভিটামিন পাওয়া যায় না।
♦ পান্তা ভাতে প্রচুর উপকারি ব্যাকটেরিয়া তৈরি হয় যা হজমে সাহায্য করে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে শক্তি যোগায়।
♦ পান্তাভাত কোলাজেন তৈরি করে যা ত্বকের ইলাস্টিসিটি রক্ষা করে এবং নতুন কোষ তৈরি করে।
♦ পান্তা ভাত আলসার নিরাময়ে সাহায্য করে।
♦ পান্তা ভাত পেট পরিষ্কার রাখতে সাহায্য করে।
পান্তা ভাত তৈরি প্রণালীঃ
নির্দিষ্ট পরিমাণ ভাতকে পানিতে প্রায় এক রাত ডুবিয়ে রাখলেই তা পান্তায় পরিণত হয়। ভাত মূলত পুরোটাই শর্করা (Carbohydrate)। ভাতে পানি দিয়ে রাখলে বিভিন্ন গাজনকারি (Fermentation) ব্যাক্টেরিয়া (Bacteria) বা ইস্ট (Yeast) শর্করা ভেঙ্গে ইথানল ও ল্যাকটিক এসিড তৈরি করে।
এই ইথানলই পান্তাভাতের ভিন্ন রকম স্বাদের জন্য দায়ী। পান্তা ভাত মূলত ভাত সংরক্ষণের একটি পদ্ধতি। ভাত বেশিক্ষণ রেখে দিলে তা পচে খাবার অনুপযোগী হয়ে পড়ে। কিন্তু পানি দিয়ে রাখলে গাজনকারি ব্যাক্টেরিয়া সেখানে ল্যাকটিক এসিড তৈরি করে যার ফলে পান্তা ভাতের অম্লত্ব বেড়ে যায় (pH কমে)। তখন পচনকারি ও অন্যান্য ক্ষতিকারক ব্যাক্টেরিয়া, ছত্রাক ভাত নষ্ট করতে পারে না।
১২-২৪ ঘণ্টা পরে পান্তা ভাত তৈরী হয়। কোন প্রকার সংক্রমন এড়াতে খাবারের পাত্রটি সতর্কতার সংগে ঢেকে রাখতে হবে।সকাল বেলা পান্তাভাত লবণ, লেবু, মরিচ এবং কাটা পেঁয়াজ দিয়ে খাওয়া হয়। খাওয়ার সময় পানি আলাদা করা হয় অনেকসময়। অনেকে পান্তাভাতের সঙ্গে ভোজ্য তেল ব্যবহার করে।
উপসংহারঃ
পান্তা ভাতে থাকা পুষ্টিকর পদার্থগুলো শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে শক্তিশালী করে। এর আয়রন দেহের রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা বাড়ায়। ক্যালসিয়াম শরীরের হাড়কে শক্ত করে। ম্যাগনেসিয়াম শরীরে নিঃসৃত এনজাইমকে সক্রিয় করতে সাহায্য করে।
পান্তা ভাতে প্রচুর পরিমাণে বিটা-সিটোস্টেরল, কেম্পেস্টেরোলের মতো মেটাবলাইটস রয়েছে যা শরীরকে প্রদাহ থেকে রক্ষা করে। এসব কোলেস্টোরেল কমাতেও সাহায্য করে।
এতে থাকা আইসোরহ্যামনেটিন-সেভেন-গ্লুকোসাইড ফ্ল্যাভোনয়েডের মতো মেটাবলাইটস ক্যান্সার প্রতিরোধে সাহায্য করে। এর ল্যাকটিক এসিড ব্যাকটেরিয়া স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী।
পান্তা ভাত যদি লাল চালের ভাতের হয় তাহলে তার পুষ্টিগুণ আরও বেশি হয়। সাদা চালের পান্তা থেকে আবার বসা ভাত অর্থাৎ মাড় না ফেলে যে ভাত রান্না করা হয় সেই পান্তা ভাতের পুষ্টিগুণ মাড় ফেলা পান্তা ভাতের থেকে বেশি হয়।
ডাবের পানি এগারো রোগের মহৌষধ! গুরুত্ব দিচ্ছেন চিকিৎসকেরাও!
সুপারফুড চিয়া সিড পৃথিবীর সবচেয়ে পুষ্টিগুণ সম্পন্ন খাদ্য বীজ!