জাপানীরা এই শিক্ষা কোথায় পায় ?
ইন্জিনীয়ারিং শেষ করে জাপানিদের সাথে কাজ করেছিলাম অনেক দিন। আমার ম্যানেজমেন্ট ট্রেনিং ও হয়েছে জাপানি ইন্সট্রাক্টর এর কাছে। তাদের কাজের ধরন বরাবরই আমাকে পুলকিত করতো।
একসাথে কাজ করার সুযোগে তাদের সম্পর্কে জেনেছিলাম অনেক। সেসব নিয়ে লেখার ইচ্ছে আছে কিন্তু তার আগেই জাপানিদের নৈতিকতা নিয়ে ডঃ আশির আহমেদ এর এই লেখাটি শেয়ার না করে পারলাম না।
জাপানী দল বিশ্বকাপে হেরে গেলেও জাপানী দর্শকরা গ্যালারী পরিষ্কার করে স্টেডিয়াম ত্যাগ করেন। এ কেমন কথা? এটা কি তোর পরাজয়ের ভাষা? ব্যাটা হেরেছিস, রেফারীর গুষ্টি তুলে গালি দে- বলে দে পয়সা খেয়েছে।
বিয়ারের ক্যান, কোকের ক্যান, চিনাবাদামের খোসা যা পাস ছুড়ে দে। দুইদিন হরতাল ডাক। অন্তত বুদ্বিজীবীদের ভাষায় এটা তো বলতে পারিস যে খেলোয়াড় নির্বাচন ঠিক হয়নি, এতে সরকার বা বিরোধীদলের হাত আছে।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে হেরে গিয়ে জাপানের সম্রাট হিরোহিতো আমেরিকার প্রতিনিধি ম্যাক আর্থারের কাছে গেলেন। প্রতীকী আইটেম হিসাবে নিয়ে গেলেন এক ব্যাগ চাল। হারাকিরি ভঙ্গিতে হাঁটু গেড়ে মাথা পেতে দিয়ে বললেন, আমার মাথা কেটে নেন আর এই চালটুকু গ্রহণ করুন। আমার প্রজাদের রক্ষা করুন। ওরা ভাত পছন্দ করে। ওদের যেন ভাতের অভাব না হয়।
আরে ব্যাটা তুই যুদ্ধে হেরেছিস তোর আত্মীয় স্বজন নিয়ে পালিয়ে যা। তোর দেশের চারিদিকেই তো পানি। নৌপথে কিভাবে পালাতে হয় আমাদের ইতিহাস (লক্ষণ সেন) থেকে শিখে নে। কোরিয়া বা তাইওয়ান যা। ওখানকার মীরজাফরদের সাথে হাত মিলা, সেখান থেকে হুংকার দে।
সম্রাট হিরোহিতোর এই ক্যারেক্টার আমেরিকানদের পছন্দ হলো। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের কুখ্যাত মহানায়কদের মধ্যে কেবলমাত্র হিরোহিতোকে বিনা আঘাতে বাঁচিয়ে রাখা হলো।
জাপানে পড়তে আসা এক বাংলাদেশী ছোট ভাই একদিন ফোনে বললো, আশির ভাই, বড়ই লজ্জায় আছি।
কেন কি হয়েছে ?
ড্রইং ক্লাসে ড্রইং বক্স নিয়ে যাইনি।
-তো?
জাপানী স্যার বড় একটা শিক্ষা দিয়েছেন।
-কি করেছে?
আমার কাছে এসে উল্টা ক্ষমা চেয়েছেন। বলেছেন, আজ যে ড্রইং বক্স নিয়ে আসতে হবে তা স্মরণ রাখার মত জোর দিয়ে আমাকে বুঝিয়ে বলতে পারেন নি। তাই সে দুঃখিত।
-হুম।
আমি তো আর কোনদিন ড্রইং বক্স নিতে ভুলবো না, আশির ভাই। আজ যদি সে আমাকে বকা দিত বা অন্য কোন শাস্তি দিত আমি কোন একটা মিথ্যা অজুহাত দিয়ে বাঁচার চেষ্টা করতাম।
২০১১ সালের ১১ই মার্চ। সুনামির আগাম বার্তা শুনে এক ফিশারি কোম্পানীর মালিক সাতো সান প্রথমেই বাঁচাতে গেলেন তার কর্মচারীদের। হাতে সময় আছে মাত্র ৩০ মিনিট। প্রায়রিটি দিলেন বিদেশিদের (চাইনিজ)। একে একে সব কর্মচারীদের অফিস থেকে বের করে পাশের উচু টিলায় নিজ হাতে রেখে এলেন। সর্বশেষে গেলেন তার পরিবারের খোঁজ নিতে।
ইতিমধ্যে সুনামি সাহেব এসে হাজির। সাতো সানকে চোখের সামনে কোলে তুলে ভাসিয়ে নিয়ে গেলেন। আজও খোঁজহীন হয়ে আছেন তাঁর পরিবার। ইসস সাতো সান যদি রানা প্লাজার মালিকের সাথে একটাবার দেখা করার সুযোগ পেতেন! সাতো সান অমর হলেন চায়নাতে। চাইনিজরা দেশে ফিরে গিয়ে শহরের চৌরাস্তায় উনার প্রতিকৃতি বানিয়ে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন।
আরও একটি ঘটনা :
নয় বছরের এক ছেলে। স্কুলে ক্লাস করছিল। সুনামির আগমনের কথা শুনে স্কুল কর্তৃপক্ষ সব ছাত্রদের তিনতলায় জড়ো করলো। তিনতলার বেলকনি থেকে দেখলো তার বাবা আসছে গাড়ি নিয়ে। গাড়িকে ধাওয়া করে ফোসফোস করে আসছে পানির সৈন্যদল। গাড়ির স্পিড পানির স্পিডের কাছে হার মেনে গেলো। চোখের সামনে নাই হয়ে গেল বাবা।
সৈকতের নিকটেই ছিল তাদের বাসা। মা আর ছোট ভাই ভেসে গেছে আরো আগে। পরিবারের সবাইকে হারিয়ে ছেলেটি আশ্রয় শিবিরে উঠলো। শিবিরের সবাই ক্ষুধায় আর শীতে কাঁপছে। ভলান্টিয়াররা রুটি বিলি করছে। আশ্রিতরা লাইনে দাঁড়িয়ে আছে। ছেলেটিও আছে।
এক বিদেশী সাংবাদিক দেখলেন, যদ্দুর খাদ্য (রুটি) আছে তাতে লাইনের সবার হবেনা। ছেলেটির কপালে জুটবে না। সাংবাদিক সাহেব তার কোটের পকেটে রাখা নিজের ভাগের রুটি দুটো ছেলেটিকে দিলেন। ছেলেটি ধন্যবাদ জানিয়ে রুটি গ্রহণ করলো। তারপর যেখান থেকে রুটি ডিস্ট্রিবিউশন হচ্ছিল সেখানে গিয়ে রুটি ফেরত দিয়ে এসে আবার লাইনে দাঁড়াল।
সাংবাদিক সাহেব কৌতুহল ঢাকতে পারলেন না। ছেলেটিকে জিজ্ঞাস করলেন, এ কাজ কেন করলে খোকা? খোকা উত্তর দিল, বন্টন তো ওখান থেকে হচ্ছে। উনাদের হাতে থাকলে বন্টনে সমতা আসবে। তাছাড়া লাইনে আমার চেয়েও বেশী ক্ষুধার্ত লোক থাকতে পারে।
সহানুভুতিশীল হতে গিয়ে বন্টনে অসমতা এনেছেন- এই ভেবে সাংবাদিক সাহেবের পাপবোধ হলো। এই ছেলের কাছে কি বলে ক্ষমা চাইবেন? ভাষা হারালেন।
যারা জাপানে থাকেন এ ধরনের ঘটনা অহরহ দেখে হয়তো অভ্যস্ত হয়ে গেছেন। আপনি ট্রেনে বাসে কোন জিনিস হারিয়েছেন, অনেকটা নিশ্চিন্তে থাকতে পারেন। ঐ জিনিস আপনি অক্ষত অবস্থায় ফেরত পাবেন।
গভীর রাতে কোন ট্রাফিক নেই, কিন্তু পথচারী ঠিকই ট্রাফিক বাতি সবুজ না হওয়া পর্যন্ত পথ পার হচ্ছেন না। ট্রেনে বাসে টিকিট ফাঁকি দেয়ার রেট প্রায় শুন্যের কোঠায়।
আমি একবার ভুলে ঘরের দরজা লক না করেই দেশে গেলাম। মাসখানেক পর ফিরে এসে দেখি, যেই ঘর রেখে গেছি, সেই ঘরই আছে।
এই শিক্ষা জাপানীরা কোথায় পায়? এটা নিয়ে লিখতে গেলে একটা পি,এইচ,ডি থিসিস হবে।
একটু আভাস দিচ্ছি –
জাপানে সামাজিক শিক্ষা শুরু হয় কিন্ডারগার্টেন লেভেল থেকে। সর্বপ্রথম যে তিনটি শব্দ এদের শিখানো হয় তা হলো-
কননিচিওয়া (হ্যালো)- পরিচিত মানুষকে দেখা মাত্র “ হ্যালো” বলবে।
আরিগাতোউ (ধন্যবাদ)- সমাজে বাস করতে হলে একে অপরকে উপকার করবে। তুমি যদি বিন্দুমাত্র কারো দ্বারা উপকৃত হও তাহলে “ধন্যবাদ” দিয়ে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবে।
গোমেননাসাই (দুঃখিত)- মানুষ মাত্রই ভুল করবে এবং সেই ভুলের জন্য ক্ষমা চাইবে।
এগুলো যে শুধু শিখানো বা মুখস্ত করে শিখানো হয় তা না। বাস্তবে শিক্ষকরা প্রো-এক্টিভলি সুযোগ পেলেই ব্যবহার করবেন এবং করিয়ে ছাড়বেন।
সমাজে এই তিনটি শব্দের গুরুত্ব যে কত তা নিশ্চয়ই অনুধাবন করতে পারছেন। এই শিক্ষাটা এবং প্রাকটিস ওরা বাল্যকাল থেকে করতে শিখে। আমাদের রাজনীতিবিদরা বাল্যকালটা যদি কোন রকমে জাপানের কিন্ডারগার্টেনে কাটিয়ে আসতে পারতেন।
কিন্ডারগার্টেন থেকেই স্বনির্ভরতার ট্রেনিং দেয়া হয়। সমাজে মানুষ হিসাবে বসবাস করার জন্য যা দরকার – নিজের বই খাতা, খেলনা, বিছানা নিজে গোছানো; টয়লেট ব্যবহার, পরিষ্কার করা; নিজের খাবার নিজে খাওয়া, প্লেট গোছানো ইত্যাদি।
প্রাইমারী স্কুল থেকে এরা নিজেরা দল বেধে স্কুলে যায়। দল ঠিক করে দেন স্কুল কর্তৃপক্ষ। ট্রাফিক আইন, বাস ট্রেনে চড়ার নিয়মকানুন সবই শিখানো হয়। আপনার গাড়ি আছে, বাচ্চাকে স্কুলে দিয়ে আসবেন? উল্টা আপনাকেই লজ্জা পেয়ে আসতে হবে।
ক্লাস সেভেন থেকে সাইকেল চালিয়ে স্কুলে যেতে পারবে। ক্লাসে কে ধনী, কে গরীব, কে প্রথম কে দ্বিতীয় এসব বৈষম্য যেন তৈরী না হয় তার জন্য যথেষ্ট সতর্ক থাকেন স্কুল কর্তৃপক্ষ। ক্লাসে রোল নং ১ মানে এই নয় যে একাডেমিক পারফরম্যান্স সবচেয়ে ভাল। রোল নং তৈরী হয় নামের বানানের ক্রমানুসারে।
বাৎসরিক ক্রীড়া প্রতিযোগীতার সমস্ত আইটেমগুলো থাকে গ্রুপ পারফরম্যান্স দেখার জন্য – ইন্ডিভিজুয়েল নয়। সারা স্কুলের ছেলেমেয়েদের ভাগ করা হয় কয়েকটা গ্রুপে- সাদা দল, লাল দল, সবুজ দল ইত্যাদি। গ্রুপে কাজ করার ট্রেনিংটা পেয়ে যায় খেলাধুলা জাতীয় এক্টিভিটি থেকে। এই জন্যই হয়তো জাপানে বড় লিডার তৈরি হয়না কিন্তু গড়ে এরা সবার সেরা।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার আগে ১২ বছর শিক্ষাটা সম্ভবত য়ুনিভার্সেল। আমাদেরটা হলো ৫ +৫ +২ অর্থাৎ প্রাইমারী ৫ বছর, হাইস্কুল ৫ বছর তারপর কলেজ ২ বছর। জাপানে ৬+৩+৩। শতকরা ১০০ ভাগ শিশুই ৬ বছর বয়সে প্রাইমারী স্কুলে ভর্তি হয়। কারো বয়স জানতে হলে সিম্প্লি জিজ্ঞাস করুন কোন ক্লাসে পড়ে। তার সাথে ৫ যোগ করে ফেলুন।
১৮ বছর বয়সে এরা সমাজে অনেকটা প্রাপ্ত বয়স্ক-র স্ট্যাটাস পেয়ে যায়। এই স্ট্যাটাসে তারা ড্রাইভিং লাইসেন্স নিয়ে গাড়ি চালাতে পারে। ছেলেরা বিয়ে করতে পারে (মেয়েদের ক্ষেত্রে ১৬ বছর)। ২০ বছর বয়সে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রাপ্ত বয়স্কে পা দেয় এবং ভোট দিতে পারে।
১৯৮৯ সালের এপ্রিল মাসের ৩ তারিখ । জাপানের কলেজে আমার প্রথম ক্লাস। ক্লাস রুটিনটা (যদ্দুর মনে পড়ছে) নিম্নরূপ-
[সকাল](১) ওরিয়েন্টশন – সবাইকে চিন, তোমাকে চিনাও (২) গ্রুপ ছবি (৩) ক্লাস রুম পরিষ্কার, টয়লেট পরিষ্কার (৪) মাঠ পরিস্কার, জিমনেশিয়াম পরিষ্কার
[বিকাল](১) ক্লাস (২) ক্লাস (৩) ক্লাস (৪) ক্লাস
ক্লাসরুম আর টয়লেট পরিষ্কার করতে আমাদের ক্লাসটিচার নিজেও লেগে গেলেন। ঘন্টা খানেকের মধ্যে ক্লাসরুম আর টয়লেট চকচকে হয়ে গেল। দশে না এগারতে মিলি করি কাজ (সাথে শিক্ষক আছেন)। হারা জিতার কোন প্রশ্ন নেই। নিজেদের কাজ নিজেরা করি। নিজ সমাজের কারিগর আমরা নিজেরাই।
কিছু মনে না করলে একটা কন্ট্রাস্ট সিনারিও শেয়ার করি।
১৯৮৫ সালের ১লা অক্টোবর। ঢাকা কলেজে আমাদের ক্লাস শুরু। একটা ইকোনো বল পয়েন্ট পেন আর নিউজপ্রিন্টের আধা দিস্তা কাগজের একটা খাতা গোল করে হাতে নিয়ে ক্যাম্পাসে গেলাম। আমাদের ওরিয়েন্টশন দিলেন নর্থ হোস্টেলের সদ্যোজাত জাতীয় পার্টির সারোয়ার বাহিনী। ক্লাস রুম, টয়লেট কোনকিছুই পরিষ্কার করতে হলো না। ক্লাসরুমের জানালার গ্লাস ভাঙলো, মাঠে ককটেল ফুটলো।
অনির্দিষ্টকালের জন্য ক্লাস বন্ধ হলো। আহা কি আনন্দ! কি আনন্দ !
লিখেছেনঃ Dr. Ashir Ahmed